
আফসানা নুরভীনঃএক সময় ছিলো শিশুরা তোতলাতে তোতলাতে নতুন শব্দ উচ্চারণ করতো — “মা”, “বাবা”, “দাদা”, “নানা”। এসব ছিল তাদের প্রথম ভাষা শেখার আনন্দঘন ধাপ। প্রতিটি শব্দে ছিল নতুন কিছু জানার উত্তেজনা, আশপাশের মানুষদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে মনের ভাব প্রকাশ করার চঞ্চলতা।
কিন্তু এখনকার দৃশ্য যেন একেবারেই ভিন্ন। শিশুর হাতেই মোবাইল, চোখ আটকে থাকে ইউটিউবের কার্টুন, আওয়াজ আর বর্ণিল অ্যানিমেশনে। বাস্তব জগতের ভাষা যেন সেখানে হারিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক শিশুই সময়মতো কথা বলতে পারছে না বা উচ্চারণ অস্পষ্ট-এ যেন এক নীরব মহামারি!
শিশুর বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় জন্ম থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত। এ সময়েই তারা শেখে কথা বলা আর অনুভব করা। কিন্তু যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা বসে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন তাদের প্রাকৃতিক শেখার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তারা পরিবারের মুখের ভাষা নয়, স্ক্রিনের কৃত্রিম শব্দ আর ভঙ্গিমাই আত্মস্থ করে। শিশুর মুখে শোনা যায় শুধুই “Hi”, “Hello”, “Wow”, “Oh no”, “Yes”—এইসব ইউটিউব শেখানো শব্দ। অথচ নিজের মাতৃভাষায় “পানি” শব্দটিও বলতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে খুবই গুরুতরভাবে দেখছেন। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস জানিয়েছে, ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের স্ক্রিন একদমই দেখা উচিত নয়। আর ২–৫ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইমই নিরাপদ।
একটি কানাডীয় গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম শিশুর ভাষাগত ও সামাজিক দক্ষতা হ্রাস করে। তারা আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না, নিজের ভাব প্রকাশে পিছিয়ে পড়ে।
তবে আশার কথা হলো— এই সমস্যার সমাধান এখনো আমাদের হাতেই। মোবাইল পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। শিশুর সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটানো, গল্প বলা, গান শেখানো, বই পড়া কিংবা একসাথে খেলা করা—এসবই হতে পারে বিকল্প।
শিশুরা জন্মগতভাবেই অনুকরণপ্রবণ। তারা যা দেখে, তা-ই শেখে। পরিবারের মানুষদের মুখের ভাষা, হাসিমুখ, সাড়া দেওয়ার অভ্যাস—সবই শিশুর প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যম। তাই তাদের হাতে কৃত্রিম স্ক্রিন নয়, তুলে দিন বাস্তব ভালোবাসা ।তাদের জন্য পর্দার রঙিনতা নয়, প্রয়োজন জীবনের বাস্তব ছোঁয়া।