
পারভেজ হাসান লাখাই থেকে : যেখানে দেশের শিক্ষার হার প্রায় ৮০% ছুঁই ছুঁই, সেখানে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার শিক্ষার হার ৬৩%।
এটি শুধু জেলার গড়ের চেয়ে কম নয়, বরং হবিগঞ্জের ৯টি উপজেলার মধ্যে সর্বনিম্ন। পর্যাপ্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার এই বেহাল দশা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা। শিক্ষক, অভিভাবক এবং সচেতন মহলের মতে, এর পেছনে শিক্ষকদের উদাসীনতা, মানহীন কিন্ডারগার্টেন এবং সামাজিক সমস্যাসহ একাধিক কারণ রয়েছে।
লাখাইয়ের শিক্ষার এই করুণ অবস্থার জন্য অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ি করছেন। অভিযোগ উঠেছে, অনেক শিক্ষক চাকরি পাওয়ার পর পরিবার নিয়ে শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। নিজেদের সন্তানদের তারা শহরের নামকরা কিন্ডারগার্টেন বা স্কুলে পড়ালেও, যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা চাকরি করেন, সেখানে তাদের সন্তানদের পড়ান না। এই দ্বিমুখী আচরণ শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্বের প্রতি উদাসীনতাকে প্রমাণ করে।সচেতন মহলের দাবি, শিক্ষকদের শহরে বসবাসের কারণে প্রতিদিন যাতায়াতে তাদের অনেকটা সময় নষ্ট হয়। তারা দেরিতে স্কুলে আসেন এবং দ্রুত ছুটি দিয়ে চলে যান, যার ফলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। তারা মনে করেন, হবিগঞ্জ জেলা শহরের এত কাছে হয়েও লাখাইয়ের পিছিয়ে থাকার পেছনে শিক্ষকদের এই উদাসীনতা ও জবাবদিহিতার অভাবই মূল কারণ।
শিক্ষকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জনপ্রতি সন্তানকে মাসিক ৫০০ টাকা করে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হলেও, অনেকেই এই সুবিধা পাওয়ার পরও নিজেদের সন্তানদের শহরের বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করাচ্ছেন। এ নিয়ে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছে। তারা মনে করেন, প্রত্যেক সরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীর সন্তানদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা উচিত। পাশাপাশি, যদি কোনো শিক্ষক তার সন্তানকে সরকারি স্কুলে না পড়ান, তবে যেন তার শিক্ষাবৃত্তি সুবিধা বাতিল করা হয়।
কেউ কেউ আরও মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে একই স্কুলে কর্মরত থেকে যেসব প্রধান শিক্ষক প্রভাব বিস্তার করছেন, তাদের বদলি করা হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে শিক্ষকদের পাঠদানের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে।
শিক্ষকদের উদাসীনতার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় লাখাইয়ের শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি কামাল মিয়া বলেন, “অভিভাবকদের অসচেতনতা, দারিদ্র্য এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো লাখাইয়ের শিক্ষার পথে বড় বাধা।” তিনি জানান, এখানকার হাওর অঞ্চলের কিছু স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা কিছু মৌসুমে কাজের সন্ধানে চলে যায়, যা তাদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। তবে, সচেতন অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, হবিগঞ্জের অন্যান্য হাওর অঞ্চলের উপজেলাগুলো যদি শিক্ষার দিক থেকে এগিয়ে থাকতে পারে, তাহলে লাখাই কেন পিছিয়ে থাকবে?
এছাড়াও, মানহীন কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণবিহীন কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে নামমাত্র শিক্ষা দেওয়া হয়, যা শিক্ষার প্রকৃত মান নিশ্চিত করে না।
স্থানীয়দের দাবি, লাখাইয়ের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে হলে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানহীন কিন্ডারগার্টেনগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো জরুরি। একইসঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে শিক্ষার এই করুণ দশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে দ্রুত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয়রা।