
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ মাসে সারাদেশে মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের দৈনিক গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১ লাখ ৪৬ হাজার ১০৯ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
আগস্টে নতুন সরকার আসার পর প্রথম কয়েক মাস পুলিশ প্রশাসন কিছুটা স্থবির থাকলেও, পরে তা আবার গতি ফিরে পায়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তুলনামূলক কম গ্রেপ্তার হলেও, এরপর সারাদেশে বিভিন্ন বাহিনীর গ্রেপ্তার বাড়তে থাকে। প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় পরের পাঁচ মাসে গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
মে মাসে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ২০৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, যা দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৪৫৮ জন। প্রথম পাঁচ মাসে দৈনিক গড় গ্রেপ্তার ছিল ৯৭৪ জন, আর পরের পাঁচ মাসের দৈনিক গড় গ্রেপ্তার দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪২৪ জনে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে দেশে দৈনিক গড় গ্রেপ্তার এক হাজারের কাছাকাছি, যা মাসে প্রায় ৩০ হাজার।
বর্তমানে বিশেষ কোনো নাম দিয়ে অভিযান না চললেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারের ব্যাপারে বেশ তৎপর। বিশেষ করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে মব সৃষ্টি, হামলা-ভাঙচুর, দখল-চাঁদাবাজির মতো আলোচিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
অপারেশন ডেভিল হান্ট
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালিত হয়। ২১ দিনে সারাদেশে ৩২ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই অভিযানে ১২ হাজার ৫০০ জন এবং অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে ১৯ হাজার ৫৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দৈনিক গড়ে গ্রেপ্তার ছিল ১ হাজার ৫২৫ জন। বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি তোলায় পরবর্তীতে এই নামে অভিযান বন্ধ করা হয়।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। জানুয়ারিতে ৪০ হাজার ৪২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪১ হাজার ১৮১ জন, মার্চে ৪৩ হাজার ৯২০ জন এবং এপ্রিলে ৪৩ হাজার ৭৬৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর আগে, ২০২৪ সালের আগস্টে ১৫ হাজার ৪৯২ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৬০৭ জন, অক্টোবরে ৩৫ হাজার ১৯২ জন, নভেম্বরে ৪১ হাজার ৬৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৩৭ হাজার ৩২৬ জন গ্রেপ্তার হন।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বর্তমানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেশি। পুলিশ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এবং অভিযানে গতি এসেছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘অ্যাক্টিভিটিজ’-এর ওপর বাড়তি নজর রাখা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা জরুরি। তিনি বলেন, যদি অভিযান বা গ্রেপ্তার শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে তা পরিস্থিতি উন্নতিতে কোনো কাজে আসে না।
কারাগারের চিত্র
সারাদেশের ৬৯টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৮৭ জন হলেও, বর্তমানে বন্দি আছেন ৭৩ হাজার ৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭০ হাজার ৪১৭ জন এবং নারী ২ হাজার ৫৮৯ জন। কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) জান্নাত-উল ফরহাদ সমকালকে জানান, প্রতিদিন কারাগারে নতুন করে ঢোকা বন্দি এবং জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা সাধারণত কাছাকাছি থাকে। সর্বশেষ ২৯ মে ২ হাজার ৫৫৩ জন কারাগারগুলো থেকে জামিনে বের হয়েছেন এবং সেদিন ১ হাজার ৮৩২ জন নতুন বন্দি কারাগারে ঢুকেছেন। তিনি আরও বলেন, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকলেও স্থান সংকুলানে সমস্যা হচ্ছে না।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার জানান, ৪ হাজার ৫৯০ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে বর্তমানে গড়ে ৮ হাজার বন্দি থাকছেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও ২ হাজার ২৪৯ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো বন্দি রয়েছেন।
রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বাড়ে। ৮ মে সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ থাইল্যান্ডে যাওয়ার পর জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে অবস্থান নেন। এ সময় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দল তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
৯ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়। ১০ মে এক দিনেই গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ২৭১ জন। ১২ মে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আরও জোরদার হয়। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দলটির ৮৭ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন আওয়ামী লীগ মিছিল বা সভা-সমাবেশ করতে না পারে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, পুলিশ কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত এক মাসে শুধু ঢাকাতেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত ২৩৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আটজন সাবেক সংসদ সদস্য রয়েছেন।
সেনা অভিযানে গ্রেপ্তার
ঢাকা সেনানিবাসে ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৪০ দিনে সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৯ হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র ও ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
এছাড়াও, গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ১ হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হাতে মোট ১৪ হাজার ২৬৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।