
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে মাদক ব্যবসা। পুরাতন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে কয়েক মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই দেখা মেলে মাদকের অবাধ হাটবাজারের। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাগানের নাচঘর ও বটতালা গেট এলাকায় শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় ফেনসিডিল।
শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে ফেনসিডিল সরবরাহ
বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে দেখা যায়, হেলমেট পরিহিত চার যুবক মোটরসাইকেল থেকে নেমে কিছু শিশু-কিশোরের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের হাতে টাকা তুলে দেন। এরপর শিশুরা চা গাছের আড়াল থেকে ফেনসিডিল এনে দেয়। মোটরসাইকেল আরোহীরা বোতল খুলেই সেবন করে ফেলে দেয় খালি বোতল। জানা যায়, প্রতি বোতল ফেনসিডিল ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যার মধ্যে শিশু-কিশোররা কমিশন পায় ১০০ টাকা।
চা গাছের ঝোপে পড়ে থাকে ফেনসিডিলের খালি বোতল
বাগানের বিভিন্ন ফাঁড়ি রাস্তায় চা গাছের ঝোপে ফেনসিডিলের অসংখ্য খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন এসব বোতল কুড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে দেয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ বাগানে অন্তত ১৫ জন চা শ্রমিক নিয়মিত মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাটির ঘরে গড়ে উঠেছে ‘ফেনসিডিল ঘর’ যেখানে প্রতি বোতল বিক্রি হয় ১১০০ টাকায়।
সীমান্তপথে আসে মাদক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নীরব
বটতলা এলাকা থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। স্থানীয়রা জানান, ভোররাতে সীমান্ত পেরিয়ে ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদক আনা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও মূল কারবারিরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু সদস্যকে ম্যানেজ করেই চলে এই ব্যবসা।
বিজিবি ও পুলিশের অবস্থান
বিজিবির তেলিয়াপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির একজন কর্মকর্তা জানান, “মাদক বিক্রয়ের প্রমাণ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিরবতা পালন করেন। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার এএনএম সাজেদুর রহমান বলেন, “তেলিয়াপাড়ায় মাদক বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।”
মূল্যভেদে বাড়ছে চাহিদা, দুর্ঘটনার ঝুঁকি
চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন ফেনসিডিলের দাম নির্ধারিত হয়। ঈদ মৌসুমে প্রতি বোতল ২ হাজার থেকে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকায় এক বোতলের দাম ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে। ফলে সহজলভ্য মাদকের জন্য চা বাগানে ভিড় করছেন বিভিন্ন জেলার মাদকসেবীরা।
অন্যান্য ব্যবসার আড়ালে চালান
অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিল পাঠানো হয়। ১২ মার্চ পাথরবোঝাই একটি ট্রাকে ৪০০ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করেছে ডিবি পুলিশ। পুরাতন মহাসড়কেও মাদকসেবীদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনায় বাড়ছে দুর্ঘটনা।
চা বাগান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের উদ্বেগ
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সাবেক ব্যবস্থাপক দীপুল কুমার সিংহ বলেন, “সীমান্ত এলাকা হওয়ায় প্রশাসনের একার পক্ষে মাদক প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ে শ্রমিকদের কাজেও।”
সীমান্তবর্তী এই চা বাগানে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে মাদক ব্যবসার বিস্তার শুধু এলাকার যুবসমাজকেই ধ্বংস করছে না, বরং সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রয়োজন স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীদের সমন্বিত উদ্যোগ।