
হামিদুর রহমান,মাধবপুর (হবিগঞ্জ)
হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড় সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী জগদীশপুর চা বাগান আজ অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাগানটি লাভের মুখ দেখছে না, বরং প্রতিবছর লোকসানে ডুবে যাচ্ছে। এই লোকসানের ভার গিয়ে পড়ছে সরাসরি সাধারণ শ্রমিকদের ওপর। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে জগদীশপুর সহ ১২ টি চা বাগান নিয়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানি গঠিত হয়।
সরকারি মালিকানাধীন ১২টি চা বাগানের মধ্যে জগদীশপুর অন্যতম, যা জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে জাতীয়তরণ করা হয়। বর্তমানে এখানে প্রায় ১১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। কিন্তু গত ১৬ বছর ধরে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু আমলা, কর্মকর্তা ও পরিচালকের যোগসাজশে বাগানটি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে এনটিসির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের সময়কালে দুর্নীতি বেড়ে যায়। জানা গেছে, পরিচালক নাফিশ শরাফতের পরিবারের সদস্যদের নামে এনটিসির ৫১% শেয়ারের সিংহভাগ কেনা হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জগদীশপুর চা বাগানে। প্রতি বছর নতুন বাগান তৈরির নামে কাগজে-কলমে বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে কোনো ফল দেখা যায় না। নার্সারিতে মানসম্পন্ন চারা না থাকায় নতুন চা গাছ নষ্ট হচ্ছে, সার-কীটনাশকের যথাযথ ব্যবহার না থাকায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
চা পাতার মান খারাপ হওয়ায় নিলাম বাজারে এর দাম কম, ফলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ও আয়—কোনোটিই সম্ভব হচ্ছে না। সরেজমিনে দেখা গেছে, বাগানে ছায়াবৃক্ষ নেই বললেই চলে, গাছগুলোও প্রায় মরাপ্রায়। শ্রমিকরা নিম্নমানের কালো চা পাতা সংগ্রহ করছেন, যা বাজারে বিক্রি করা কঠিন।
প্রতিবছর যন্ত্রাংশ কেনা ও মেরামতের নামে কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে এই অর্থ আত্মসাৎ করছেন। এর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের জীবনযাপন এখন মানবেতর। দুই বছর ধরে শ্রমিকদের রেশন তলব বন্ধ বা অনিয়মিত। অনেক শ্রমিক পরিবার সপ্তাহশেষে রেশন না পেয়ে না খেয়ে থাকেন। ঘরবাড়ি মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেই, হাসপাতাল বলতে একটি জরাজীর্ণ ঘর, যার মধ্যেও চিকিৎসক নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং গর্ভবতী নারী শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে, যার ফলে গর্ভকালীন জটিলতা বাড়ছে।
মিঠুন মুন্ডা, বিশু সাঁওতালসহ একাধিক শ্রমিক জানান, “এখন বাগানে কোনো রকমে টিকে আছি। টাকা নেই—এই অজুহাতে রেশন তলব বন্ধ। যারা দুর্নীতি করেছে তারা নিরাপদে চলে গেছে, কিন্তু আমরা এই জঙ্গলেই রয়ে গেছি, কোথাও যাবার উপায় নেই।”
বাগানের বর্তমান ম্যানেজার মনির হোসেন, যিনি চার মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি দাবি করেন—“বাগানে অতীতে অনিয়ম হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। তবে আমি দায়িত্ব নেবার পর থেকে উন্নয়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।”