
বাংলাদেশে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনো সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা পায়নি, তবে সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এই খবর দিয়েছে বিবিসি বাংলা।
প্রতিটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের মূল দায়িত্ব থাকে নির্বাচন কমিশনের উপর। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ঠিক করলেও, যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনি আইন-বিধি সংশোধন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আসন পুনর্বিন্যাস, এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুমোদন।
এই বিশাল প্রস্তুতির জন্য নির্বাচন কমিশন সাধারণত একটি পরিকল্পনাপত্র বা রোডম্যাপ প্রকাশ করে। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচন কমিশন প্রায় দেড় বছর আগেই রোডম্যাপ ঘোষণা করে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন।
বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচন সংক্রান্ত নানা ধরনের অনিশ্চয়তার কারণে কমিশনের ভেতরেই রয়েছে দ্বিধা। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, রোডম্যাপ ঘোষণার উপযুক্ত সময় এসেছে কিনা তা নিয়ে তাদের মধ্যে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
এর আগের কমিশন, যার নেতৃত্বে ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল। এবার এখনো নির্বাচনকাল চূড়ান্ত না হওয়ায় রোডম্যাপ ঘোষণার দিনক্ষণ স্থির করা যাচ্ছে না।
তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম গত মাসে বলেছেন, তারা আশা করছেন জুন বা জুলাইয়ের মধ্যেই একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করতে পারবেন।
নির্বাচনি রোডম্যাপ আসলে কী?
নির্বাচনের পরিকল্পনাপত্র বা রোডম্যাপ একটি সময়ভিত্তিক তালিকা যেখানে বলা থাকে কী কাজ কবে এবং কীভাবে সম্পন্ন করা হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ থেকে শুরু করে নতুন দলের নিবন্ধন, নির্বাচনি আইন সংস্কার, আসন পুনর্বিন্যাস, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, ব্যালট পেপার তৈরি, পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমোদন—সবকিছুই এতে উল্লেখ থাকে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক কমিশন কর্মকর্তা জেসমিন টুলী জানান, এই রোডম্যাপ শুধু নির্বাচন কমিশনের কাজের গাইডলাইন নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতির জন্যও জরুরি। সময়মতো রোডম্যাপ প্রকাশ না হলে কমিশনের পক্ষেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশন ১২টি ধাপভিত্তিক পরিকল্পনা যুক্ত করে একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছিল। সেই তালিকায় ছিল আইন সংশোধন, সংলাপ আয়োজন, আসন পুনর্বিন্যাস, ভোটার তালিকার সিডি প্রকাশ, সরঞ্জাম কেনাকাটা, ব্যালট পেপার ছাপা, এবং নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।
সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন ব্যালট বাক্স, কালি, স্ট্যাম্প প্যাড কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাওয়া হয়েছে এবং বাজেট বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
ভোটার তালিকা নিয়ে প্রস্তুতি
ভোটার তালিকা হালনাগাদ নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যারা ১৮ বছর পূর্ণ করবে তারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যদি ভোট হয় ২০২৬ সালের জুনে, তাহলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে যারা প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তাদের তালিকাভুক্ত করা হবে।
এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং আসন পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক ঐকমত্যের দিকেও নজর
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ নির্ধারণে আরেকটি বড় অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব। সরকার গঠিত ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে মোট ৯টি সুপারিশ সরকারকে দেওয়া হয়েছে, যার কিছু বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ইসি এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে এবং কতটা খরচ হবে সে বিষয়ে প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে। তবে এখনো রাজনৈতিক ঐকমত্য চূড়ান্ত না হওয়ায় রোডম্যাপ তৈরির কাজ পুরোপুরি এগোচ্ছে না।
জেসমিন টুলী মনে করেন, যদি শেষ মুহূর্তে সীমানা পরিবর্তন, না-ভোট চালু, কিংবা ভোটারের বয়সসীমা পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত আসে, তাহলে কমিশনের পূর্বপ্রস্তুতি অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এই পর্যায়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা শুধু ঐকমত্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, নিজেদের প্রস্তুতিও সমানতালে এগিয়ে নিচ্ছে।