
পারভেজ হাসান লাখাই প্রতিনিধি : হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার ৫নং করাব ইউনিয়নে কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজে ব্যবহৃত সাইনবোর্ডে প্রয়োজনীয় তথ্য, বিশেষ করে প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখ না থাকায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এমনকি, গ্রামবাসীর নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত সড়কেও রহস্যজনকভাবে কাবিখা প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিটি রাস্তায় দৃশ্যমান সাইনবোর্ড লাগানো বাধ্যতামূলক এবং তাতে প্রকল্পের ব্যয়, রাস্তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও প্রকল্পের সভাপতির নাম উল্লেখ থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু করাব ইউনিয়নের বহু স্থানে লাগানো সাইনবোর্ডে শুধুমাত্র প্রকল্পের নাম ও সভাপতির নাম উল্লেখ থাকলেও প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ বা রাস্তার বিস্তারিত তথ্য অনুপস্থিত। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে কাজ চললেও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআই) অফিস এসব বিল পরিশোধ করে যাচ্ছে, যা নিয়ে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছে।
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে ৫নং করাব ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মনতৈল গ্রামে। স্থানীয় আক্তার মিয়ার দোকান থেকে মনতৈল বড় কাল পর্যন্ত একটি রাস্তা তিন থেকে চার মাস আগে গ্রামবাসী নিজেদের উদ্যোগে প্রায় ৩১ হাজার টাকা ব্যয় করে মাটি ভরাট করে সংস্কার করে। অথচ গত ৩০ জুন হঠাৎ করে এই রাস্তার পাশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাবিখা প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়, অর্থ বছর ২০২৪-২৫ লেখা একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এই সাইনবোর্ডেও কোনো অর্থের পরিমাণ, রাস্তার আয়তন বা সময়সীমা উল্লেখ ছিল না। এলাকাবাসীর দাবি, এই রাস্তায় কাবিখা প্রকল্পের আওতায় কোনো কাজই করা হয়নি। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সাইনবোর্ড লাগানোর পর ৭-৮ ট্রলি মাটি এনে রাস্তার কিছু অংশে ফেলা হয়, যা “শাক দিয়ে মাছ ঢাকার” মতোই বলে মনে করছেন তারা। এই প্রকল্পে ৩.২১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেখানো হয়েছে।
প্রকল্পের সভাপতি ও ইউপি সদস্য তাসলিমা আক্তার জানান, সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু চেয়ারম্যান সাহেব করেছেন। আমি এ বিষয়ে কিছু বুঝিনা এবং সাইনবোর্ডে কী লেখা ছিল বা কোথা থেকে এসেছে তাও জানি না। তবে তিনি জানান, এই রাস্তায় যে বরাদ্দকৃত টাকা এসেছে, তা থেকে গ্রামবাসী নিজেদের অর্থে যে মাটি ভরাট করেছে, সেই টাকা তাদের দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং বাকি টাকা পরিষদে রেখে দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি ইউপি চেয়ারম্যান কুদ্দুস সাহেবের নাম উল্লেখ করেন। এটি নিয়ম বহির্ভূত কিনা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
৫নং করাব ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, গ্রামবাসী মিলে রাস্তাটি করায় আমি “মর্মাহত” হয়েছি এবং মনে মনে চিন্তা করেছি যে চেয়ারম্যান থাকতে গ্রামবাসী কেন রাস্তা করবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রকল্পের টাকা থেকে গ্রামবাসীর যে টাকা ব্যয় করে রাস্তা মাটি ভরাট করেছে সেই টাকা ফেরত দেবো। এটি নিয়মে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনিসঠিক উত্তর দিতে পারেননি।তিনি আরো বলেন সাবেক মেম্বার আলী আকবরকে সাথে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান। জনগণ এই বিষয়ে অবগত নয় বললে তিনি বলেন, “সবাইকে তো আর অবগত করা যায় না, সেটা পার্সোনালি আমি সাবেক ইউপি সদস্য আলী আকবর মেম্বারের সাথে কথা বলে রেখেছি।” বরাদ্দকৃত টাকা রাস্তায় কাজ না করে কেন আগের কাজের টাকা ফেরত দেবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সেটা দেখা যাবে।” এই ধরনের নিয়ম কাবিখা প্রকল্পে আছে কিনা জানতে চাইলে তখনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে সাবেক ইউপি সদস্য আলী আকবরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রায় একমাস আগে চেয়ারম্যান আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। চেয়ারম্যান বলেছেন যাদের টাকায় রাস্তাটি হয়েছে তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেবে, চেষ্টা করে দেখি একটি প্রকল্প এ রাস্তা আনতে পারি কিনা। এ বিষয়ে আশেপাশের লোকজন জানে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন এ বিষয়টি আমি বলতে পারব না।
এলাকার গ্রামবাসী ও স্থানীয়দের প্রশ্ন, যখন তারা নিজেদের অর্থ ও শ্রমে রাস্তার কাজ করেছেন, তখন কেন সেই রাস্তায় কাবিখা প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগানো হবে? যেখানে সাইনবোর্ডে বরাদ্দকৃত ব্যয় ও বিস্তারিত তথ্য থাকা বাধ্যতামূলক, সেখানে এগুলো ছাড়া কিভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বিল অনুমোদন করছেন, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে ঘোর সংশয় তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, এটা কি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দায়িত্বের প্রতি অবহেলা, নাকি অন্য কিছু, তা খতিয়ে দেখা দরকার। করাব ইউনিয়নে কাবিখা প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের বহু রাস্তায় সাইনবোর্ড নেই, আবার কোথাও থাকলেও তাতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কিছুই উল্লেখ নেই – এমন অবস্থায় কীভাবে এসব প্রকল্পের বিল পাস হচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম রাকিব বলেন, “আমরা বিষয়গুলো দেখবো।” সাইনবোর্ডে রাস্তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে, এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, “এগুলো আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবে। একদিনে এগুলো অভ্যাসে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।” সঠিক তদারকি না করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আবারও সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন। প্রকল্পের বরাদ্দকৃত টাকা থেকে গ্রামবাসীর ব্যয় করা অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এ ধরনের কোনো নিয়ম নেই বলে জানান।